সম্পত্তি সমর্পণ

 পড়া শুরু করার আগেই বলে দেই যে কোনো উপন্যাস বা বিশাল প্রবন্ধ গ্রন্থ নিয়ে আলোচনায় বসব না। বরং বলতে হয় আজ আলোচনা করব অত্যন্ত ছোট একটি গল্প নিয়ে।


 হ্যাঁ! 


অত্যন্ত ছোট একটি গল্প।ওই  ছোট প্রাণ,ছোট ব্যাথা ও ছোট ছোট দুঃখকথা নিয়ে যে গল্প গুলো হয় না? সেরকম একটা নিয়ে। 


অসাধারণ এই গল্প টি সবার আগে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো সাধনা পত্রিকার পাঠক দের। 


হ্যাঁ। ১২৯৮ এর কোনো এক পৌষে সাধনা পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়েছিলো এই গল্পটি। সেই থেকে বলা যায় সাধনার পাঠকেরা বলতে গেলে মোটামুটি সাধনাহীন ভাবেই গল্পটি পড়তে পেরেছিল।


গল্পটি কবিগুরুর গল্পগুচ্ছ গ্রন্থ থেকে নেওয়া। এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ কি না তা বলতে পারি না, কারন এখনো পড়াই শেষ হয় নি।হয়তো বা বই এর গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে গল্পের মান ও বাড়বে।  তবে গল্পটির শুরুর দিকের একটা লাইন বেশ ভাবনার খোড়াগ জুগিয়েছিলো। লাইনটি হলো, ‘কিন্তু আধুনিক লোকেরা প্রাচীন নিয়মে মরিতে ও  চায় না।’ 


ডাহা সত্য কথা!


সেই প্রাচীন নিয়মে মরিতে না চাওয়া, প্রাচীন নিয়ম মানিতে অস্বীকার করাই তো তাদের আধুনিকতার মূল ভিত্তি । কিন্তু একবার চিন্তা করুন তো কবিগুরুর  কথাটা।  তিনি তার বাক্যটা লিপিবদ্ধ করেছিলেন আজ থেকে প্রায় ১২৯ বছর আগে। যে জগৎ তিনি তৈরি করেছেন তার প্রেক্ষাপট আরো আগের। অর্থাৎ এত এত বছর আগে ও আধুনিকতার প্রচলন ছিলো।  সেকালে তখনো  সেকালের মানুষ ছিলো। সেকালের তরুণেরাও সেকালের বৃদ্ধ দের সেকেলে রীতি কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতো! আর সেকালের সেই বৃদ্ধ ও হয়তো তার যৌবনে তার বাপ দাদার সেকালের প্রাচীন নিয়ম ভেঙ্গে তাদের অবাক করে দেওয়ার কথা ভুলে গিয়ে  নিজেই আধুনিক তরুণের কথা শুনে  অবাক হয়ে যেতো!  কী আশ্চর্য না?


গল্পটির আধুনিকতার প্রসঙ্গ আসার কারন বৃন্দাবন কুন্ডের বউ এর অসুখ! ব্যাটা কিনা বউ এর অসুখ সারানোর জন্য বিপুল ব্যায়ে কিপ্টা বাপের পকেট হতে টাকা খসিয়া ঔষধ আনতে যায়! সাহস কত ব্যাটার! ঔষধ এর দরকার কী? তার মা,দিদিমা রা যখন মরেছে তখন কী তারা ঔষধ খেয়েছে? 


না তো? তাহলে এই পুরাতন রীতি ভেঙে আধুনিক ভাবে মরার দরকার টা কী শুনি? 


টাকা দিলো না বাপ যজ্ঞনাথ কুন্ড! বউ ও আর আধুনিক নিয়মে মরলো না । জামাইয়ের মা আর দিদিমার পুরাতন নিয়ম সেও বজায় রাখলো।


কিন্তু ব্যাটা বৃন্দাবন একটা নাছোড়বান্দা!  বাপের সাথে তেড়ে আসে!  বলে কিনা বউ মৃত্যুর জন্য নাকি বাপ দায়ী! 


অবশেষে একদিন বাপের সাথে ঝগড়া করে অল্পবয়সী পুত্র কে নিয়ে চলে গেলো সে। 


কোথায় গেলো? 


কেউ জানে না৷ 


 বলতে গেলে এখান থেকেই গল্পটি শুরু!  যজ্ঞনাথের নাতি ও বৃন্দাবনের পুত্র রুপে এই গল্পে যার ভূমিকা ছিলো তার নাম গোকুলচন্দ্র।বয়স সবে চার। খরচ অপেক্ষাকৃত ভাবে কম করার কারনে তার প্রতি যজ্ঞনাথের বিদ্বেষ প্রায় ছিল না বললেই চলে। কিন্তু তারপরেও কেন জানি নিরুপদ্রব ভাবে বেচে থাকা যজ্ঞনাথ এর  পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে পড়লো। 



এই গল্পের দুটি লাইন এ এসে আটকে গিয়েছিলো। তার মধ্যে বোধ করি দ্বিতীয় লাইন টি পাঠক দের পিলে চমকানোর জন্যই লেখা হয়েছিলো। 


সেটি হলো, ‘‘সেখানে ও কে ডাকিল, ‘বাবা’।’’ 


গোকূল চন্দ্র কে নিয়ে তার পিতা বৃন্দাবন যখন  চলে যায় তার  পর যজ্ঞনাথ  যেন কেমন হয়ে গেলো ! দুপুর বেলা যখন একটি বিশেষ শ্রেণী বাদে গৃহস্থের প্রায় সকলেই ঘুমিয়ে যেতো তখন যজ্ঞনাথ হুঁকা হাতে করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতো। 


এবং ঐ বিশেষ শ্রেণী অর্থাৎ ঘর পালানো বালকেরা তাহার স্বভাব নিয়ে তার নিত্যনতুন নামকরণ করিত। 


একদিন ঐ বালক দের দলে নতুন একজন কে দেখা গেলো যে কিনা বালকদের সর্দার হয়ে উপদ্রপের নতুন পন্থা আবিষ্কার করতেছিলো এবং সুযোগ বুঝে তার প্রয়োগ ও ঘটিয়ে দিলো।


ছেলেটির নাম ছিলো নিতাই পাল। হয়তো নতুন এই উপদ্রপের পন্থার কারনেই ছেলেটির প্রতি তার মায়ার সৃষ্টি হলো। পাঠশালার ভয়ে বাপের কাছ হতে  পালিয়ে আসা ছেলেটি কে নিজের ঘরে আশ্র‍য় দিলো বৃদ্ধ। শুধু এটুকুই নয় রীতিমতো তাদের দুজনের বেশ গাঢ় সম্পর্ক হয়ে গেল।যদিও সম্পর্ক টা ছিলো অসম।এমন কি বৃদ্ধ তার বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির সবটাই তাকে দিয়ে যাবার আশ্বাস ও দিতেন। 


বৃদ্ধের এইরুপ পাগলামি দেখে পাড়ার লোক নিতাই এর বাপ কে খবর দিলো। তাহার বাপ দামোদর  এর আসার খবর শুনে বৃদ্ধ ও নিতাই দুজনেই বেশ চিন্তায় পড়ল। সিদ্ধান্ত হলো আজ রাতেই নিতাই কে লুকিয়ে রেখা আসা হবে। 


অনেক রাতে বাড়ি থেকে বের হলো তারা। বেশ অনেকক্ষন  হাটার পর দেবতাহীন এক ভাঙা মন্দিরে উপস্থিত হলো। মন্দিরের মধ্য থেকে এক খন্ড পাথর বের করে তার ভিতর দিয়ে মন্দির এ ঢুকে গেলো তারা। 


চারিদিকে পিতলের কলসি। আর সেই কলসি ভর্তি মোহর ও টাকা। 


যজ্ঞনাথ সেই বালক টি কে আসনে বসালো। গলায় ফুলের মালা দিলো। কপালে চন্দন ও সিঁদুরের টিপ দিলো। তারপর তাকে দিয়ে বারবার বলিয়া লইলো, ‘‘যুধিষ্ঠির কুন্ডের পুত্র গদাধর কুণ্ড তস্য পুত্র  প্রাণকৃষ্ণ কুণ্ড তস্য  পুত্র পরমানন্দ কুণ্ড তস্য পুত্র যজ্ঞনাথ কুণ্ড তস্য পুত্র বৃন্দাবন কুন্ড তস্য পুত্র গোকুলচন্দ্র কুণ্ডকে কিংবা তাহার পুত্র অথবা পৌত্র অথবা প্রপৌত্র কে কিংবা তার বংশের ন্যায্য উত্তরাধিকারীকে এই সমস্ত টাকা গণিয়া দিব। ’’ 


বার বার শুধু একই কথা তাকে দিয়ে বলিতে লাগিল বৃদ্ধ। একটা সময় সে তাকে রাখিয়াই উপরে বের হয়ে যেতে লাগলো। 


বের হওয়ার পথে সে রুদ্ধ শ্বাস কন্ঠে  শুনলো , ‘' দাদা, আমি বাবার কাছে যাব। ’’ 


বের হওয়ার পরে ও সা বারবার শুনিতে লাগল, ‘বাবা’ ‘বাবা’। মনে হলো যেন পৃথিবীর অতলস্পর্শ হতে সে যেন কান্নার আওয়াজ পেতে লাগলো। সে প্রস্তর খন্ড আগের জায়গায় রাখিয়া তার মাটি চাওয়া দেওয়া শুরু করলো। এক সময় সেই আওয়াজ বন্ধ হলো। বৃদ্ধ তার সম্পত্তি ও তার উত্তরাধিকারীদের অধিকার নিশ্চিত করে মন্দির থেকে বের হয়ে আসছিলো।  


সেখানেও কে ডাকিল, ‘‘বাবা’’।

 

মোটামুটি এই হলো সেই পিলে চমকানো লাইনের ইতিহাস। গল্প টি যারা পড়েছে তাদের কাছে এই লাইনটি বলতে গেলে গল্পের টার্নিং পয়েন্ট! এই লাইনটি যার মুখ থেকে বেরিয়েছে সে হলো যজ্ঞনাথ এর পুত্র ও নিতাই পালের বাবা। উভয়ে একই ব্যাক্তি। 



Comments

Popular posts from this blog

কুহেলিকা : এক প্রেমিক, এক বিপ্লবী ও এক সন্তানের গল্প

একজন হুমায়ূন আহমেদ...... ও কয়েকটি মধ্যদুপুর!