একজন হুমায়ূন আহমেদ...... ও কয়েকটি মধ্যদুপুর!
সময়টা ২০১৭ সাল। শীতের আমেজ।তাই বলা যায় সময় টা বছরের শুরুর দিকে। পড়াশোনার তেমন চাপ নেই দিনগুলো কোনোরকমে কেটে যাচ্ছিল।কোনো অভিযোগ ছিল না, কোনো চিন্তা ও ছিল না।
সকাল ৮ টায় এসেম্বলি, সপ্তাহে ৩ দিন। রবি, মঙ্গল আর বৃহস্পতি। শুক্র, শনি বন্ধ।আর বাকী দুইদিন ক্লাসটিচারের জন্য বরাদ্দ। আমাদের বাস ছাড়তো ৭ টা ১৫ এর দিকে। আমি ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে খাওয়া-দাওয়া করে ৭ টা ৫-১০ এর দিকে বের হয়ে যেতাম। স্কুলে পৌঁছোতে ৪০ বা ৪৫ মিনিট এর মতো সময় লাগতো। এই সময় টা কিছু করার ছিল না। হয় সিটে বসে বসে যতসব উদ্ভট আর অবাস্তব জিনিস নিয়ে চিন্তা করো আর না হয় বড় ভাইয়া দের দল করে হেড-টেল খেলো। আমি ও আমার বন্ধুরা দ্বিতীয়টার প্রতিই ভেশি আগ্রহী ছিলাম। প্রায় প্রত্যেকদিন সকালে ওই হেড-টেল খেলেই সময় টা পার করতাম।
অন্য একটি দিনের কথা। সবকিছু আগের মতোই চলছিল। বাস ছেড়ে দিবে। আমাদের হেড-টেল খেলা শুরু করার কথা। আশফাক ভাইয়া খেলার জন্য তাগাদা দিলেন। এমন সময় সিয়াম প্রস্তাব টা নাকচ করে দিল। বলল, ‘আমাকে বই পড়তে হবে।আমার কাছে আর সময় নেই। আজকেই শেষদিন। ’
আমি উৎসাহী হয়ে উঠলাম। বললাম, ‘কী বই? কোথা থেকে আনলি? ’
সে বইটি দেখাল। জাফর ইকবালের কোনো একটি বই। সে বলল, ‘লাইব্রেরী থেকে। সপ্তাহে একটা দেয়। আজকেই জমা দিতে হবে এটা।’
আমি বললাম, ‘আমারে নিয়া যাবি?’
সে বলল, ‘আজকে না। মঙ্গলবার।’
আমি রাজি হয়ে গেলাম। ওই দিন আর খেলা হলো না৷ আমি চিন্তায় বিভোর হয়ে রইলাম।
দু-দিন কেটে গেল। আজকেই মঙ্গলবার। লাইব্রেরী তে নিয়ে যাওয়ার কথা। সিয়াম নাকচ করে দিলো। বলল, ‘আজকে পারবো না। অন্যদিন।’
আমি অবাক হয়ে রইলাম। বললাম, ‘কেন পারবি না? তুই না বললি নিয়া যাবি?’
সিয়াম বলল, ‘এমনেই। অন্যদিন নিয়া যাবো।’
আমি আর জোরাজোরি করলাম না। অন্যদিনের চিন্তায় আবারো বিভোর হয়ে রইলাম।
সেই অন্যদিন ও এলো।
যার যে জায়গায় নামার কথা সে জায়গায় না নেমে আমরা আরো সামনে নেমে গেলাম। আমাদের উদ্দেশ্য লাইব্রেরী।
মূল ছবি: Russell John
হাঁটা পথে মোট দূরত্ব ৫ মিনিটের। আমার তাড়াহুড়ায় সময় ৪ মিনিটে নেমে এলো। ৫ তলা বাসা। ২য় তলায় তার লাইব্রেরী। খুব তাড়াতাড়ি সিড়ি বাইতে লাগলাম।
এবার আমার বিষ্ময়ের পালা। ঢাকা শহরে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা দিলে যত বড় ঘর পাওয়া যায় লাইব্রেরীটা ঠিক ততটুকু জায়গা নিয়ে গড়া৷ মাঝারি সাইজের বুক সেল্ফ। কম করে হলেও ১০-১৫ টা। প্রতিটি বুক-সেল্ফ বই দিয়ে ঠাসা।হুমায়ূন আহমেদ থেকে শুরু করে হুমায়ূন আজাদ,জাফর ইকবাল থেকে শুরু করে জন গ্রিসাম,আনিসুল হক থেকে আহসান হাবীব। সবাই আছে৷ প্রত্যেকে, যাদের নাম পড়েছি কবিতার পাশে,গল্পের শেষে।যাদের জীবন বৃত্তান্ত পড়েছি পাশের জন্য।সেই প্রত্যেকে আছে সেখানে। তাদের অপ্রকাশিত,অপরিচিত গ্রন্থ গুলো নিয়ে৷
আমি প্রথম সেল্ফটির দিকে এগিয়ে গেলাম। ১ম তাক ৩ টায় হুমায়ূন আহমেদ,পরের ২ টায় জাফর ইকবাল আর শেষেরটি তে ইমদাদুল হক মিলন। আমার প্রথমটির উপরে চোখ পড়লো। প্রথম বইটির উপর। আমার পড়া প্রথম বইটির উপর৷ ‘এবং হিমু’ তার নাম। আমার পড়া প্রথম বই।
আমি পরমভালোবাসায় বইটি হাতে নিলাম। ৩-৪ বছর আগে পড়া প্রথম বই। সেই সময়কার কথাগুলো মনে পড়ে গেল। সেই দিনগুলো কীভাবে কাটতো তার কথা মনে পড়ে গেল।আমি সেই দিনগুলো তে হারিয়ে গেলাম।
কার্ড হাতে পাওয়ার পর সেই প্রথম বাড়ি এনেছিলাম।সাথে নতুন এক ধরনের গন্ধ! পরবর্তীতে অনেকবার সেই গন্ধের জন্য হাহাকার করেছি৷ সেই পুরনো গন্ধ!যেন কত সহস্র বৎসর আগের।
বই নিতে বেশি সময় লাগতো না। অতি অল্পক্ষণ এর ব্যাপার। কিন্তু আমার বেশ সময় লাগতো। আমি তাকিয়ে থাকতাম বইগুলোর দিকে৷ কোনো চিন্তা করতাম না। শুধুই তাকিয়ে থাকতাম। নাম গুলো পড়তাম৷ বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল,তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে, তোমাদের এই নগরে, পারাপার সহ আরো কত কী! হুমায়ূন আহমেদের দেওয়া এই নামগুলোর দিকে তাকিয়েই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম। সময় যে কখন কেটে যেতো কোনো হুশ থাকতো না। লাইব্রেরিয়ান আমাকে ডাকতো, ‘এই শুভ্র! কোন বইটা নিবা?’
সেই সময় টা পার করে এসেছি। এখন নিজের সংগ্রহে প্রায় ১০-১২ হাজার টাকার বই আছে। কিন্তু এখনো নির্জন দুপুর গুলোর কথা খুব মনে পড়ে। সারাদিন স্কুলে কাটাতাম শুধু ছুটির পর লাইব্রেরী তে যাওয়ার আশা করে। নীরবে তাকিয়ে থাকতাম তার বইগুলোর দিকে। আর নীরবে চলে যেতো সময়!

Comments
Post a Comment